Pages

Monday, September 22, 2014

জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব



বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে যে বিবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং ইতোমধ্যে পড়েছে, তার বিস্তারিত নিচে উল্লেখ করা হলো:

মরুকরণ
বন্যা
ঝড়
সমুদ্রপৃষ্ঠের
উচ্চতা বৃদ্ধি
কৃষিতে
অনিশ্চয়তা
মালাউয়ি
বাংলাদেশ
ফিলিপাইন
সব নিচু দ্বীপদেশ
সুদান
ইথিওপিয়া
চীন
বাংলাদেশ
ভিয়েতনাম
সেনেগাল
জিম্বাবুয়ে
ভারত
মাদাগাস্কার
মিসর
জিম্বাবুয়ে
ভারত
কম্বোডিয়া
ভিয়েতনাম
তিউনিশিয়া
মালি
মোজাম্বিক
মোজাম্বিক
মলদোভা
ইন্দোনেশিয়া
জাম্বিয়া
নাইজার
লাওস
মঙ্গোলিয়া
মৌরিতানিয়া
মরক্কো
মৌরিতানিয়া
পাকিস্তান
হাইতি
চীন
নাইজার
ইরিত্রিয়া
শ্রীলঙ্কা
সামোয়া
মেক্সিকো
ভারত
সুদান
থাইল্যান্ড
টোঙ্গা
মিয়ানমার
মালাউয়ি
শাদ (চাদ)
ভিয়েতনাম
চীন
বাংলাদেশ
আলজেরিয়া
কেনিয়া
বেনিন
হন্ডুরাস
সেনেগাল
ইথিওপিয়া
ইরান
রুয়ান্ডা
ফিজি
লিবিয়া
পাকিস্তান
বৈশ্বিক উষ্ণতার ঝুঁকিতে থাকা পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ১২টি দেশের তালিকাসূত্র: বিশ্ব ব্যাংক

বৃষ্টিপাত হ্রাস

ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের ১৯৫১ থেকে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের সংগৃহীত উপাত্তের ভিত্তিতে নয়াদিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক সায়েন্সেস বিভাগের উদ্যোগে বৃষ্টিপাতের ব্যাপ্তি, বর্ষা মৌসুমের ব্যাপ্তি ও বৃষ্টির পরিমাপ ইত্যাদি উপাত্ত যাচাই করে দেখা গেছে যে, ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত কমছেদেখা গেছে, চারদিনের বেশি সময় ধরে কমপক্ষে ২.৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের ঘটনা কমে গেছেযদিও স্বল্প সময়ের জন্য বৃষ্টিপাত বেড়েছে কিন্তু এতে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের চক্র দূর্বল হয়ে গেছেএই পরিস্থিতি এজন্য আশংকাজনক যে, এই উপমহাদেশের কৃষিকাজ দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টির উপযোগী ইতোমধ্যেই (২০০৯) বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে, ধানের ফুল আসার সময় থেকে বীজ বের হওয়ার মাঝখানের সময়টুকুতে প্রয়োজনের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় টি-আমন জাতের ধানের উৎপাদন কমে আসছে এমনকি ভরা বর্ষায় জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় অনাবৃষ্টিতে আমন ধানের বিশাল খেত রোদে পুড়ছে (২০১০)যেখানে আমন ধান রোপনের অন্তত ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত পানি ধরে রাখা নিশ্চিত করতে হয়, নাহলে কুশি বাড়ে না; সেখানে পানির অভাবে জমিতে ফাটল দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে (৪৭,৪৪৭ মিলিমিটার), বিগত ১৫ বছরের তুলনায় (১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের পরে) সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, এমনকি এই পরিমাণ শ্রেফ ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের তুলনায়ই ,০০০ মিলিমিটার কম

লবণাক্ততা বৃদ্ধি

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে নাফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসেফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়দক্ষিণ-পশ্চিম যশোরে এমনটা দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় যায়, দেশের দাকোপসহ দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র ভূভাগের অনেক ভিতর পর্যন্ত লোনাপানি ইতোমধ্যেই (২০০৯) ঢুকে পড়েছেএই সমস্যা উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং কুমিল্লা পর্যন্ত উত্তর দিকে বিস্তৃত হয়েছে (২০১০), এবং আরো উত্তরে বিস্তৃত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে দেশে লবণাক্ত ভূমির পরিমাণ ছিল ৮,৩০,০০০ হেক্টর, আর ২০০১ খ্রিস্টাব্দে এসে তা হয়েছে ৩০,৫০,০০০ হেক্টর কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিনে দিনে আরো প্রকট হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত
বরিশাল পটুয়াখালীতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মাত্রা) থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়ে গেছে (প্রেক্ষিত ২০০৯) চট্টগ্রাম শহর সন্নিকটের হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি হয়ে গেছে (২০০৯)
সাতক্ষীরা-খুলনার সুন্দরবন
বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক গঠনই এমন যে, কোথাও কোথাও ভূভাগ যথেষ্ট ঢালু খুলনার সুন্দরবনের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যা ত্রিভূজাকৃতির বঙ্গোপসাগরের শীর্ষবিন্দুতে গাঙ্গেয় মোহনায় অবস্থিতএই গাঙ্গেয় মোহনার মহীঢাল খুব মসৃণভাবে সমুদ্রে নেমে গেছেএর ফলে আন্দামান সাগরে উৎপন্ন জলঘুর্ণিঝড়গুলোর উত্তরমুখী যাত্রায় মহীঢালের অগভীরতার কারণে জলোচ্ছাস অত্যন্ত উঁচু হয়ে আসেসাগরের জোয়ারও অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়তাই সাগরের লোনাপানি ঢুকে পড়ে উপকূলভাগে, লবণাক্ত করে তোলে ভূ-অভ্যন্তরের পানিও
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছে ব্যাপক মাত্রায় আগামরা রোগ দেখা দিয়েছেঅনেকে একে মানবসৃষ্ট কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাইলেও গবেষকরা একে প্রাকৃতিক কারণ হিসেবেই সনাক্ত করেছেনসুন্দরবনের অন্যান্য গাছও আগামরা ও পাতা কঙ্কালকরণ পোকার আক্রমণের শিকার হচ্ছেআক্রান্ত হচ্ছে বাইনের বাগানওসুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ ইতোমধ্যেই পানির উচ্চতাজনিত কারণে লবণাক্ততার শিকারএদিকে ননিয়ানরেঞ্জ আক্রান্ত হওয়ার মুখে (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০)

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা

বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ সেই পরিচিতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় এলাকায় সর্বোচ্চ ৪২.৩° সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয় ৪৫.১° সেলসিয়াস, রাজশাহীতে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে এসে নথিভুক্ত করা হয় ৪৩° সেলসিয়াস২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ এপ্রিল নথিভুক্ত করা হয় বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.২° সেলসিয়াস, যশোরে কিন্তু বস্তুত, অতীতের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিলো কম, অথচ বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা অত্যধিক বেশিকেননা, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড বা WWF-এর গবেষণায় দেখা যায়, শুধু ঢাকা শহরেই মে মাসের গড় তাপমাত্রা ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ঐ মাসের তুলনায় বেড়েছে ১° সেলসিয়াস (২০০৯ প্রেক্ষিত)৷ নভেম্বর মাসে এই তাপমাত্রা ১৪ বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ০.৫° সেলসিয়াস৷ আবহাওয়া অধিদপ্তরসূত্রে জানা যায় গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.৫% এমনকি ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে ১.৪° সেলসিয়াস এবং ২১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ২.৪° সেলসিয়াস বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে
তাপমাত্রা বাড়ার ঘটনাটি অনেকটা সম্পুরক হারে ঘটবেকেননা বাড়তি তাপমাত্রার কারণে পানির বাষ্পীভবন বেড়ে যাবে এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবে বাতাসে জলীয় বাষ্প বেড়ে যাওয়া মানে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়া আর্দ্র বাতাসের প্রভাবে প্রকৃত তাপমাত্রা না বাড়ালেও অনুভূত তাপমাত্রা (feels like) বেড়ে যাবেফলে তাপমাত্রার তুলনায়ও বেশি গরম অনুভূত হবে ইতোমধ্যেই একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আর্দ্রতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছেতাছাড়া ২০৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০-১৫ ভাগ এবং ২০৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তা প্রায় ২৭ ভাগ বেড়ে যাবে ফলে বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বেড়ে যাবে চরম হারেএই আর্দ্রতা গরম বাড়িয়ে দিবেউল্লেখ্য, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO)-র মতে, ২০১০ খ্রিস্টাব্দ ছিল ২৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বের উষ্ণতম বছর, আর ২০০১ থেকে ২০১০ সময়টুকু ছিল বিশ্বের উষ্ণতম কাল
গ্রীষ্মকালে যেখানে তাপমাত্রা বাড়বে, শীতকালে ঠিক একইভাবে তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে কমবে২০০৩ খ্রিস্টাব্দের পর ২০১১ খ্রিস্টাব্দে প্রচণ্ড শ্বৈতপ্রবাহের কবলে পড়ে বাংলাদেশশ্রীমঙ্গলে নথিভুক্ত করা হয় ৬.৪° সেলসিয়াসপরিবেশ ও জলবায়ুবিদদের মতে, এসময় অনুভূত তাপমাত্রা হয়েছিল আরো কম

মরুকরণ

দিনে দিনে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে, সময়মত হচ্ছে না বন্যা২০০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২৩০০ মিলিমিটার, বরেন্দ্র এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১১৫০ মিলিমিটার এরকম স্বল্প বৃষ্টিপাত দিন দিন বেড়েই চলেছেএর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গিয়ে খরায় আক্রান্ত হবে বিপুল সংখ্যক মানুষ, এর মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লোকই বেশিএরকম খরায় কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তার ব্যাপারে বিভিন্ন উৎস থেকে আলাদা আলাদা উপাত্ত পাওয়া যায়কারো মতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ খরায় উদ্বাস্তু হবে প্রায় ৮০লক্ষ মানুষ

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস

বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়ে দেখা দিচ্ছে স্থায়ী মরুকরণ রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নেমে যাচ্ছে পানির স্তর যদিও এর মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণ, বিশেষ করে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবও দায়ী, তবে অনাবৃষ্টির দরুণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এছাড়া সুপেয় পানির অভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায়ও ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাচ্ছে

 

 

সুপেয় পানির অভাব

২০০৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরির্বতন-সংক্রান্ত প্যানেলের (IPCC) পানিসম্পদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ সমুদ্রতীরের বেশ কটি দেশে সামনের দিনে মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এ সমস্যা ভয়াবহ রূপ নেবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ায় অনেক এলাকায় দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির অভাববিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এই অভাব প্রকট নওগাঁ জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, ধামইরহাট, পত্নীতলা -এই পাঁচটি উপজেলা নিয়ে যে বরেন্দ্রভূমি, সেখানকার সরকারি-বেসরকারি ৫৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় সবকটিতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ায় স্বাভাবিক নলকূপগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে, ফলে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০) এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই যেখানে পানির স্তর হ্রাস পায়, তার উপর ঐসময় গাছপালার প্রস্বেদন বেড়ে যাওয়ায় ভূগর্ভের সুপেয় পানির অভাব দেখা দিচ্ছে অন্যদিকে লোনা পানির আগ্রাসনে উপকূলীয় এলাকায় দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকটমৃত্তিকাসম্পদ গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্যমতে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ নদীর পানি লোনা হতে থাকে ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে তা পুরোপুরি লোনা হয়ে যায়তথন নদীর পানি মুখেও তোলা যায় না ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীর পানি আরো আগেভাগেই লোনা হয়ে গেছে চট্টগ্রাম শহরের খাবার পানি সরবরাহের একমাত্র উৎস হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মান) হয়ে গেছে (২০০৯)পরিশোধন-অযোগ্য এই বিপদের ফলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রামে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (IMW)-এর গবেষকগণ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগতন্মধ্যে ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, বন্যা, নদীভাঙন এবং ভূমিধ্বসের মাত্রাবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যআগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পরপর বড় ধরণের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছর পরপরই বড় ধরণের দুর্যোগ হানা দিচ্ছে৷  এমনকি, ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্র্যাফ্‌ট-এর তালিকায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচ-এর প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে বড় ধরণের প্রায় ২৫৪টি দুর্যোগ আঘাত হেনেছে
১. বাংলাদেশ
২. ইন্দোনেশিয়া
৩. ইরান
৪. পাকিস্তান
৫. ইথিওপিয়া
৬. সুদান
৭. মোজাম্বিক
৮. হাইতি
৯. ফিলিপাইন
১০. কলম্বিয়া
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের তালিকাসূত্র: ম্যাপলক্র্যাফ্‌ট

ঘুর্ণিঝড় বা টর্নেডো

স্থলভাগে ঘুর্ণিবায়ু বা ঘুর্ণিঝড় বা টর্নেডোর আঘাত এখন প্রায় নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছেঅকষ্মাৎ ঘুর্ণিবায়ু আঘাত হানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় ঝড়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় (২য়) ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কুড়িগ্রামের রৌমারি উপজেলার সোনাপুর চরে মাত্র ১ মিনিট স্থায়ী একটি শক্তিশালী টর্নেডো ৪০টি ঘর উড়িয়ে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রে ফেলে এছাড়া সমুদ্রস্তরের উচ্চতাবৃদ্ধি এবং উপকূলে লবণাক্ততা বাড়ায় সূর্যের তাপে তুলনামূলক ঘন লোনাপানি বেশি তাপ শোষণ করে গরম হয়ে উঠে এবং অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়ফলে লবণাক্ততা-আক্রান্ত উপকূলাঞ্চল তুলনামূলক গরম হয়ে উঠছে দিনে দিনেগাছ কম থাকার কারণে এবং পানি দীর্ঘক্ষণ তাপ ধরে রাখায় এই গরম স্থায়িত্ব পায়এধরণের সীমিত অঞ্চলভিত্তিক আবহাওয়াগত পরিবর্তন আঞ্চলিক টর্নেডো ডেকে আনছে
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP)দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত ঝুঁকির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে শীর্ষে দেখানো হয়েছেগবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে বছরে প্রতি লাখে প্রায় ৩৩ জন মারা যাচ্ছে
১. বাংলাদেশ
২. ভারত
৩. ফিলিপাইন
৪. হন্ডুরাস
৫. ভিয়েতনাম
৬. চীন
জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদনে (২০১০) ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশসূত্র: UNDP

জলোচ্ছাস

জলোচ্ছাস বা সাইক্লোন যদিও স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জন্য একটি নৈমিত্তিক ঘটনা, কেননা ভারত মহাসাগরের উত্তর দিকের এই অঞ্চলটি যথেষ্টই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চলপ্রায় প্রতি বছরের এপ্রিল, মে, জুন এবং সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বরে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ ও নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় ও তা জল-ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় আর সেই তান্ডবে ব্যাপক জলোচ্ছাসে তলিয়ে যায় উপকূলবর্তি হাজার হাজার একর স্থলভাগ বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯৫, ১৯৯৭, ২০০০, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে জল-ঘূর্ণিঝড় হলেও তা তেমন ক্ষয়ক্ষতি করেনি ২০০১ থেকে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলতে গেলে তেমন কোনো ঘূর্ণিঝড়ই হয়নি কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে একদিকে যেমন বাড়ছে এসব জলোচ্ছাসের তীব্রতা, তেমনি বাড়ছে এদের সংখ্যা ২০০৭ খ্রিস্টাব্দেই ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর তার মারাত্মক প্রভাব রেখে যেতে না যেতেই তার পিছু পিছু ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের রা মে ধেয়ে আসে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, একই বছর ২৬ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় রেশমি, ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় খাইমুক, ২৬ নভেম্বর নিসা, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল বিজলি, এবং ঐ বছরই ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলাঘূর্ণিঝড় আইলায় কক্সবাজার উপকূলে বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়সেই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত নিয়ে এখনও মানবেতর জীবন-যাপন করছে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক উপকূলীয় মানুষকেউ কেউ স্থায়ী জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সাগরে ৬টি জল-ঘূর্ণিঝড় এবং ১০৭টি লঘু নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছেআবহাওয়া অধিদপ্তসূত্রে জানা গেছে আবহাওয়া খারাপ হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত থেকে শুরু করে বিপদসংকেত পর্যন্ত দেয়া হয়জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্র দিনে দিনে বিক্ষুব্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ থেকে ২১ জুলাই টানা ৯ দিন চট্টগ্রাম মংলা বন্দরকে এবং কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে হয়েছিলোএসময় কোনো জেলের পক্ষে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া সম্ভব হয়নি এছাড়া জলোচ্ছাসের কারণে সমুদ্র থেকে আসা লোনা পানি উপকূলীয় এলাকার স্বাদু পানিকে লোনা করে দেয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (IWM)-এর গবেষণামতে, বাংলাদেশের উপকূলের ১৪টি শহর জলোচ্ছাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে

ঘূর্ণিঝড় সিডর আক্রান্ত প্রত্যন্ত এলাকায় নৌকায় ত্রাণ বিতরণ
 
স্থায়ী জলাবদ্ধতা
জলোচ্ছাসের সময় সমুদ্র থেকে আসা লোনা পানিতে অনেক নিম্নভূমিতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতাএছাড়া প্রচন্ড জল-ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভেঙ্গে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো, বেড়িবাঁধফলে অবাধে লোনা পানি প্রবেশ করে জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দেয়ইতোমধ্যেই (২০০৯) সাতক্ষীরা খুলনার চারটি উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিডর আইলার কারণে বেড়িবাঁধের এক-তৃতীয়াংশ ভেঙ্গে যাওয়ায় অবাধে প্রবেশ করছে জোয়ারের পানি, সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতাএমনকি শীতকালেও ঘরে পানি চলে আসে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেয়া বাস্তুহারা মানুষদের

শিলাবৃষ্টি

দিনে দিনে শিলাবৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশেপ্রতি বৈশাখে সাধারণত প্রাকৃতিক স্বাভাবিক কারণেই মাঝে মাঝে শিলাবৃষ্টি হয় এদেশেকিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০) বাংলাদেশে শিলাবৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে তাছাড়া ইদানিং শিলাবৃষ্টির শিলার আকৃতিও দিনে দিনে বড় হয়ে যাচ্ছেযেমন: ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ রাতে প্রচন্ড ঝড় ও শিলাবৃষ্টি বয়ে যায় লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ হাতীবান্ধা উপজেলার উপর দিয়েঐ রাতের প্রায় ২০ মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টিতে কালীগঞ্জ উপজেলার লতাবর, সতীরপাড়, বোতলা, খামারভাতি, চন্দ্রপুর, শিয়ালখাওয়া, চাকলা, গোড়ল, বলাইরগহাট, মদাতী, বুড়িরহাট, চামটা, ও হাতীবান্ধা উপজেলার জাওরানী, দক্ষিণ জাওরানী, ভেলাগুঁড়ি, কাদমা ও কাশিমবাজার এলাকার অধিকাংশ টিন ও খড়ের ঘরের চাল পর্যন্ত বিধ্বস্থ হয়ে যায়স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ছোট শিলার ওজন আধা কেজির কম হবে না আর বড়গুলো দেড় কেজির মতোকেউ কেউ ওজন করে দেখেছেন বলেও দাবি করেন এতো বড় বড় শিলাবৃষ্টির আঘাতে অনেকের টিনের ঘর ঝাঁঝরা হয়ে যায়লোকজন ও গবাদি পশু আহত হয়নষ্ট হয়ে যায় লিচুর আবাদ, ক্ষতিগ্রস্থ হয় গম, তামাক, ভুট্টা আর বোরো ক্ষেতপ্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, এর আগে এতো বড় শিলার আঘাত তারা কষ্মিনকালেও শোনেননি

অতিবৃষ্টি ও তীব্র বন্যা

বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম (১ম) বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছেপ্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০৯৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং প্রতি বছরই প্রায় ১৫ লক্ষ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে থাকেএদিকে পূর্বানুমান করা হয়েছে যে, শুধু বাংলাদেশেই ২০৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০-১৫ ভাগ এবং ২০৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তা প্রায় ২৭ ভাগ বেড়ে যাবে এই বাড়তি পানি বাংলাদেশের উপর দিয়ে সমুদ্রে যাবার সময় সৃষ্টি করবে তীব্র বন্যাএমনকি ২০১০ খ্রিস্টাব্দে বিগত ১৫ বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হলেও উত্তরাংশের সিলেট রাজশাহীতে বিগত ২ বছরের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় হাকালুকি হাওরসহ উত্তরাঞ্চলের বিপুল নিচু এলাকা প্রায় ৭ মাস ধরে প্লাবিত রয়ে যায় এরকম ভয়াবহ বন্যায় কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তার ব্যাপারে বিভিন্ন উৎস থেকে আলাদা আলাদা উপাত্ত পাওয়া যায়কারো মতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বন্যায় উদ্বাস্তু হবে প্রায় ৭০০লক্ষ মানুষ উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (IWM)-এর গবেষণামতে, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের বন্যার পর দেশে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ ১৮% বেড়েছে এবং বর্তমানে (২০০৯) পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের ৩৪টি শহর বন্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে

নদীভাঙন


বাংলাদেশে, সাধারণত বর্ষাকালে উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুন নদীর পানি বেড়ে যায় এবং তা প্রচন্ড গতিতে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়এসময় উপকূলীয় অঞ্চলের নদীসংলগ্ন স্থলভাগে পানির তীব্র তোড়ে সৃষ্টি হয় নদীভাঙনেরবাংলাদেশে এটা স্বাভাবিক চিত্র হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় তা আর স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হচ্ছে নাপানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যমতে, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছেআরও প্রায় ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিতে পারেএতে কৃষি জমির এক বিরাট অংশ নদীগর্ভে তলিয়ে যাবে অথচ এর বিপরীতে যে চর জেগে উঠছে, তা অপ্রতুল



নদীভাঙনের কবলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পদ্মা নদীসংলগ্ন মনপুরা চর

 
ভোলা
বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (CEGIS) উপগ্রহের মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে যে, ১৯৭৩-২০০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভোলার মূল ভূভাগ থেকে ২৪০ বর্গ কিলোমিটার জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে উপগ্রহচিত্রে দেখা যায় ভোলার উত্তর-পূর্ব দিকে ভাঙনের প্রবণতা বেশিযদিও একই সময়ে ৭০ বর্গ কিলোমিটার নতুন চর ভোলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু ভাঙনের তুলনায় তা যৎসামান্যপানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জানা যায়, ২০০৪-২০০৮ -এই চার বছর ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে, আর ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে তা সর্বোচ্চ হয়েছে
কোপেনহেগেনে জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (২০০৯) বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনগুলির একটিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছেএবং আরও প্রায় ৫০০ কিলোমিটার জুড়ে নতুন করে ভাঙন দেখা দিতে পারে
ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নেরর একটি অংশের নাম ঘর রাজাপুর, অন্য অংশটির নাম বাহির রাজাপুরবাহির রাজাপুরে ৬ বছর আগেও (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৯) ১৭টি গ্রাম ছিলো; ভাঙনের ফলে তা এসে ঠেকেছে মাত্র ৬টিতেপাশাপাশি ২০০৯ সালে ভাঙন কবলিত ছিলো সীতারাম এবং উত্তর রামদাসপুরমনপুরা উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে বিগত ১৫ বছরের তুলনায় ২০০৯ সালের ভাঙনের হার বেশি (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৯)



উপগ্রহের তথ্যানুযায়ী তৈরি করা হাতিয়া ও ভোলার ভূমিগঠন ও ভাঙনের চিত্র

হাতিয়া
২০০৯ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটে হাতিয়ার উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাংশের তমরদ্দি, চরকিং ও চরঈশ্বর ইউনিয়ন এবং সুখচর ও নলচিরার অবশিষ্টাংশ ব্যাপক ভাঙনের কবলে রয়েছেনদীভাঙনের পর হাতিয়া উপজেলা পরিষদ ১৯৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান উপজেলা সদর ওছখালিতে স্থানান্তর করা হয়েছিলো ভাঙনের কবলে ইতোমধ্যেই রাজকুমার সাহার হাট, মনু বেপারির হাট, হিজিমিজির বাজার, নায়েবের হাট, সাহেবের হাট, নলচিরা বাজার, সাহেবানী বাজার, চৌরঙ্গী বাজার, জাইল্লা বাজার, মফিজিয়া বাজার, নলচিরা নতুন বাজার ও ভুঞার হাট মেঘনাগর্ভে হারিয়ে গেছেহাতিয়া উপজেলা সরকারি কমিশনার (ভূমি) অফিসসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভাঙনের কবলে উপজেলার সাগরদি, চরবাটা, মাইজচরা, চর হাসান-হোসেন, চরকিং, উত্তর চরকিং, কাউনিয়া, চরবগুলা, চরআমানুল্লাহ, দক্ষিণ চরআমানুল্লাহ মৌজাগুলো মেঘনাগর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছেএছাড়া আরো ২০টি মৌজার বেশিরভাগই নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে
হাতিয়া যে হারে ভাঙছে, সে হারে নতুন জমি হাতিয়ার সাথে যুক্ত হচ্ছে নাসিইজিআইএস-এর উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষিত মত হলো ১৯৭৩-২০০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হাতিয়ার মূল ভূভাগ থেকে ১৫০ বর্গ কিলোমিটার জমি নদীতে বিলীন হয়েছেদেখা যায়, হাতিয়ার চারদিকই ভাঙছে, তবে প্রবণতা বেশি উত্তরদিকেপলি জমে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাত বর্গকিলোমিটার জমি যুক্ত হলেও ভাঙনের তুলনায় তা যৎসামান্য
নিঝুম দ্বীপ
নিঝুম দ্বীপে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা বন ধ্বংসের পথেনদীভাঙন ছাড়াও ঘূর্ণিঝড় আইলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই কৃত্রিম উপকূলীয় বনটিদিনে দিনে বনটি ছোট হয়ে আসছেএই বন বিলুপ্ত হলে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্দ বঙ্গোপসাগরের আগ্রাসনে টিকতে পারবে না দ্বীপের ২২,০০০-এরও বেশি মানুষ, আর ২০,০০০-এর মতো হরিণ

ভূমিধ্বস

ভূমিধ্বস (Landslide) বিশ্বের অন্যান্য দেশে বেশ পরিচিত হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উঁচু পাহাড়-সংলগ্ন এলাকায় এই দুর্যোগ ইদানিং বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে ইদানিং দেখা দিচ্ছে এই ভূমিধ্বস বা ল্যান্ডস্লাইডএই এলাকায় ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে যে ভূমিধ্বস হয় তা শ্রেফ পানি, বালু আর মাটিই না, সাথে করে নিয়ে আসে বড় বড় পাথর খন্ডএমনকি কয়েক ফুট ব্যাসের পাথরখন্ডও নেমে এসেছে পাহাড় থেকেএজাতীয় ভূমিধ্বসের স্বীকার হয়েছে এই উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের চানপুর, টিলাপাড়া, নয়াছড়া, পাহাড়তলী, কড়ইগড়া গ্রামের প্রায় ৯৫% আদিবাসী বাসিন্দাএলাকার বিভিন্ন বাড়ির উঠান আর পুকুর বালি-পাথরে ঢাকা পড়েছে, মরে যাচ্ছে গাছপালাএমনকি মেঘালয় পাহাড়ের মনাই, কড়ইগড়া], চিত্ত, রাজাই, গারো, চানপুর, বুরুঙ্গা, পাগলা, বড়ছড়া, টেকেরঘাট, লাকমা, লালঘাট, বাঁশতলা, চারাগাঁও, কলাগাঁও, রন্দু, সুন্দরবন, বাগলি, নয়াছড়া নামে যে ১৯টি ছড়া রয়েছে সেগুলো হয়ে এপারে বাংলাদেশে জাদুকাটা, বৌলাই, রক্তি'র সঙ্গে এসে এসব পাথর খন্ড নামছে, ফলে পানির রং হয়ে পড়েছে বিবর্ণএরকম বালু ও পাথরখন্ডে ঢেকে গেছে উপজেলার প্রায় ৩০০ একর ফসলি জমি এরকম পাথরের টুকরো মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দিচ্ছেলোকজন ঘরবাড়ি বদল করে অন্যত্র স্থানান্তরিত হচ্ছে; কেউ কেউ কয়েক ফুট গভীর গর্ত করে তা থেকে মাটি নিয়ে ভিটেমাটি উঁচু করছেএসব এলাকার লোকজন এর আগে আর কখনোও এমন অবস্থার কথা শোনেননিবিশেষজ্ঞের অভিমত হচ্ছে, মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলে বালুর পরিমাণ কমবেশি থাকে, তবে পাথরখন্ড আসা এবং বালুর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তা একপ্রকারের দুর্যোগজলবায়ু পরিবর্তনে পাহাড় দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এমনটা ঘটতে পারে আশঙ্কার কথা হলো, প্রতি বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধ্বস দিনে দিনে বাড়ছে

ভূমিকম্প বৃদ্ধি

প্রাকৃতিকভাবেই কার্বন চক্রের প্রভাবে ভূমিকম্প হয়ে থাকে, বাংলাদেশেও তার ব্যতয় হয়নাএদেশের ভিতরে ও পার্শ্ববর্তি এলাকার বিগত প্রায় ২৫০ বছরের ভূমিকম্পের নথিভুক্ত তালিকা পাওয়া যায় তালিকা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ১০০'রও বেশি ভূমিকম্প; তন্মধ্যে ৬৫টিরও বেশি ঘটেছে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের পরেএ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিগত ৩০ বছরে (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৪) ভূমিকম্প সংঘটনের মাত্রা বেড়েছে
বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, যথা: বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মায়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছেভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরণের নড়াচড়ার, অর্থাৎ বড় ধরণের ভূ-কম্পনেরএছাড়াও পৃথিবীর মোট ১১টি মূল টেকটনিক প্লেটের ৭ নম্বর প্লেটটি মেঘালয়-মিয়ানমার-পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতবঙ্গোপসাগরের তলদেশে মিয়ানমারের কাছেই সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলে প্লেটটি আরেকটি প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে এবং সেখানে একটি চ্যুতি (রাখাইন চ্যুতি) তৈরি হচ্ছে, যা ৬.৫ থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে হয় ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্পএমনকি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (BUET) মানমন্দিরে জানুয়ারি ২০০৬ থেকে মে ২০০৯ পর্যন্ত ৪ বছরে, রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার ৮৬টি ভূ-কম্পন নথিভুক্ত করা হয়এই সময়ের মধ্যে ৫ মাত্রার চারটি ভূ-কম্পনও ধরা পড়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানমন্দিরে মে ২০০৭ থেকে জুলাই ২০০৮ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভূ-কম্পন নথিভুক্ত করা হয়, তন্মধ্যে ৯টিরই রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫-এর উপরে, এবং সেগুলোর ৯৫%-এরই উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে অতীতের এসব রেকর্ড থেকে দেখা যায় ভূমিকম্পের মাত্রা না বাড়লেও ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভূমিকম্প সংঘটনের হার বেড়েছে, অর্থাৎ ঘন ঘন স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছেমতবিরোধ থাকলেও অনেক ভূতাত্ত্বিক ছোট ছোট ভূমিকম্প সংঘটন বড় ধরণের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে উল্লেখ করেন অতীতের এসব রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন যেকোনো সময় বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে


বাংলাদেশে, ১৭ বছরের ব্যবধানে ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকার পরিমাণ বৃদ্ধি

বুয়েটের গবেষকদের প্রস্তুতকৃত ভূ-কম্পন-এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১% এলাকা মধ্যম (জোন-২) এবং ১৬% এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছেযেখানে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ভূ-কম্পন মানচিত্রে ২৬% উচ্চ, ৩৮% মধ্যম এবং ৩৬% নিম্ন ঝুঁকিতে ছিলনতুন মানচিত্র অনুযায়ী, মাত্রাভেদে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অবস্থান নিম্নরূপ:
জোন-১: পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পূর্ণ অংশ, এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি কক্সবাজারের অংশবিশেষ
জোন-২: রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী এবং ঢাকা
জোন-৩: বরিশাল, পটুয়াখালী, এবং সব দ্বীপ চর



বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের তীব্রতার ভিত্তিতে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র:GSB)
জোন-১
জোন-১-এ অবস্থিত বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখেকারণ সিলেট-সুনামগঞ্জ ভারতের শিলংকে বিভক্ত করেছে ডাওকি নদী, আর এই ডাওকি নদী ডাওকি চ্যুতি (Dauki fault) বরাবর অবস্থান করছে, আর ভূতাত্ত্বিক চ্যুতিগুলোই বড় ধরণের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটের সীমান্ত এলাকাবর্তী এধরণের চ্যুতিগুলোর কোনো কোনোটিতে সাব-ডাউন ফল্ট রয়েছে, যেগুলো ভূমিকম্প ঘটালে বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে কারণ এতে করে পাথারিয়া অন্তর্চ্যুতি (Patharia anticline) নিচের দিকে মোচড় দিতে পারে
জোন-২
জোন-২-এ অবস্থিত রাজশাহী জেলা, ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রীয় ভূমিকম্প এলাকায় অবস্থিত এবং তাই ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সক্রীয় ভূমিকম্প এলাকায় থাকার কারণে এই অঞ্চলও যেকোনো সময় মারাত্মক ভূমিকম্পের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে পারে
জোন-২-তে থাকা রাজধানী শহর ঢাকায় সে হিসেবে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হবার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা বা ফল্টলাইন নেইতবে ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হবার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা রয়েছেসরকারি তথ্যসূত্রমতে, ঢাকায় রাতের বেলায় ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৯০,০০০ লোক হতাহত হবেদিনের বেলায় হলে হতাহতের সংখ্যা হবে ৭০,০০০ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের ৩,২৬,০০০ ভবনের উপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২,০০০ ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, আরও ৮৫,০০০ ভবন মাঝারি ধরণের ক্ষতিগ্রস্ত হবেশুধু দালান ভাঙার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ এমনকি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনোসিস অফ আরবান এরিয়াস এগেইন্সট সাইসমিক ডিযাসটার (রেডিয়াস) জরিপে ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম
এছাড়াও জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (টিআইটি)-র সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত এক সাম্প্রতিক (২০১০) গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার ভূমিতে বিভিন্ন প্রকারের মাটি (লাল মাটি, নরম মাটি ইত্যাদি) রয়েছে ঢাকার সম্প্রসারিত অংশে জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা আবাসন এলাকা রয়েছে ভূমিকম্পের সময় নরম মাটি ও ভরাট করা এলাকার মাটি ভূমিকম্পের কম্পন তরঙ্গকে বাড়িয়ে দেয়, ফলে ভূমিকম্পের তীব্রতা বাড়েমাটির বৈশিষ্ট্যের সাথে যোগ হয় ভবনের বা স্থাপনার কাঠামোএই দুইয়ের সম্মিলনে ভূমিকম্পের তীব্রতা ও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্যতা বাড়ে-কমেগবেষকরা তাই ঢাকার বর্ধিতাংশের আলগা মাটিসমৃদ্ধ জনবসতিকে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন

সুনামির সম্ভাবনা

বাংলাদেশের সামগ্রিক ভূতাত্ত্বিক অবস্থা পর্যালোচনাপূর্বক ভূতাত্ত্বিকদের অভিমত, বঙ্গোপসাগর অভ্যন্তরে F1, F2, F3 এবং F4 নামে ৪টি ভূ-কম্পন উৎস রয়েছেএগুলোর প্রতিটিই রিখটার স্কেলে ৭-৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি করতে পারে এবং যেকোনো সময় ভূমিকম্প সৃষ্টি করে সুনামি ঘটাতে পারে  ভূমিকম্প সংঘটনের মাত্র ৩০মিনিট থেকে ১ঘণ্টার মধ্যে সুনামি, বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রতলে সৃষ্ট একটি ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়েছিলো, এমনকি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে ২১০০ কিলোমিটার দূরের সুমাত্রা থেকে বাংলাদেশের ফাটল বরাবর সৃষ্ট একটি ভূমিকম্পের দরুণ সৃষ্ট সুনামি প্রায় ৩ঘণ্টা পরে বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়েছিলো১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ফাটলটি এখনও সক্রিয় আছেঅস্ট্রেলীয় একদল বিজ্ঞানীর একটি জরিপে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে, বাংলাদেশের নদীবিধৌত পলি সমুদ্রতলে যেসকল পাহাড় বা টিলার সৃষ্টি করেছে, ভূমিকম্পের কারণে সেগুলোতে ধ্বস সৃষ্টি হলেও বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারেবিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশের উপকূলে ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ফল্ট এলাকায় ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি প্রায় ৪মিটার (১৩ফুট) উচ্চতার সুনামি বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে: নিঝুম দ্বীপ ৩মিটার (১০ফুট), সুন্দরবন, কক্সবাজার এবং ভোলার কিছু অংশ ২মিটার (৬.৫ফুট), ছোট ছোট চর ও দ্বীপাঞ্চল যেমন মনপুরা, মেঘনার মোহনা ইত্যাদি ২মিটার (৬.৫ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছাস দ্বারা প্লাবিত হবেএরকম সুনামি আঘাত হানলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল ও সাতক্ষীরায় কয়েকশত কিলোমিটার সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চল বিপর্যস্ত হবে বলে আশংকা করা হয়

সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি (SLR)

বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগ থাকায় দিনে দিনে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ডুবে যাবার আশংকায় রয়েছে বাংলাদেশ UNFCCC'র দেয়া তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরো ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়লে মালদ্বীপ সহ তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী দেশ বাংলাদেশও  জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল-এর তথ্যমতে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অন্তত ১৭% ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে৷  'দ্যা সায়ন্টিফিক কমিটি অন এন্টার্কটিক রিসার্চ' (SCAIR) জানিয়েছে, যে হারে এন্টার্কটিকার বরফ গলছে, তাতে ২১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৫ ফুটবিগত দিনের পরিসংখ্যানের প্রায় দ্বিগুণ এই হিসাবের প্রেক্ষিতে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা DFDI এপরিমাণ উচ্চতাবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবার আশংকা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম এরকম অকষ্মাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দেশের প্রায় ৮%-এরও বেশি নিম্নাঞ্চল ও প্লাবনভূমি আংশিক এবং/অথবা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়বে এছাড়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড বা WWF-এর মতে সমৃদ্রস্তরের উচ্চতাবৃদ্ধিতে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে এইসব ভবিষ্যত সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষিত পেরিয়ে বর্তমানেই (২০০৯) সুন্দরবনে সর্বপ্রথম, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অনুভূত হয় কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্যমতে, ২০০০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত সমুদ্র, প্রতি বছর ৩ মিলিমিটার (০.১২ ইঞ্চি) করে বাড়ছিল, কিন্তু পরবর্তি দশকেই প্রতি বছর ৫ মিলিমিটার (০.২ ইঞ্চি) করে বাড়া শুরু হয়েছে এবং ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে সার্কের "আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র" (SMRC)-এর একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, হিরণ পয়েন্ট, চর চাঙ্গা, এবং কক্সবাজারে জোয়ারের পানির স্তর প্রতি বছর, যথাক্রমে ৪.০ মিলিমিটার, ৬.০ মিলিমিটার এবং ৭.৮ মিলিমিটার বেড়েছে
এদিকে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের চেয়েও আরো বেশি হারে ডুবে যাচ্ছেকারণ প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর উপকূলের এলাকাসমূহের মাটি দেবে, বসে যাচ্ছেইতোমধ্যেই একটি গবেষণা থেকে ভারতের কলকাতা শহরে, মাটি বসে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে এছাড়া আরো দুটি গবেষণায় ভবিষ্যতে লখনৌ এবং পাটনার ভূমি বসে যাবার সম্ভাব্যতা দেখানো হয়েছেযদিও বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে, ভূমি, প্রতি বছর ৫মিলিমিটার বসে গেলেও, পলি জমে আরো ৭মিলিমিটার উঁচু হয়ে যায় ভূত্বককিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে নদীর পানি বা বন্যার পানি সর্বত্র পৌঁছাতে পারে না, ফলে পলি পৌঁছতে পারছে না সেসব স্থানেআর তাই ভূমি বসে যাবার তুলনায় সব স্থানে ভূমি উঁচু হচ্ছে না গবেষণা সঠিক হলে, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অতিরিক্ত হারে বাংলাদেশ ডুবে যাবে; এতে যেমন মানুষের হস্তক্ষেপ আছে, তেমনি আছে প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন

সাতক্ষীরা-খুলনার সুন্দরবন

ইউনেস্কো'র প্রতিবেদন মতে, সমুদ্রস্তরের ৪৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে সুন্দরবনের ৭৫% ডুবে যেতে পারে ইতোমধ্যেই (২০০৯) সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহীন অরণ্যে, বঙ্গোপসাগর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্পসহ ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার এলাকার ভূমি সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে, যেখানে সুপেয় পানির একমাত্র উৎস একটি পুকুর ছিল৷ নদীভাঙনের ফলে জঙ্গলের ছোট ছোট খাল ও নদী পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের পানি একবার উঠলে আর নামতে পারছে না; পরবর্তী জোয়ারে আরও ভেতরে পানি যাচ্ছে বলে এসব এলাকার গাছপালার বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে৷

সুন্দরবনে কাদা-চর

 

প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নানারকম প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে বাংলাদেশেঅনেক প্রজাতিই হারিয়ে যেতে বসেছেগাছ, মাছ, পাখি, ফুল, ফল সবকিছুতেই এই প্রভাব পড়ছে ইউনেস্কোর "জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ"  শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের ৭৫% ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷  একথা অনস্বীকার্য যে, এই বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাসে পরিবেশের উপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়বে

মৎস্যসম্পদ হ্রাস

অভ্যন্তরীন মৎস্য আহরণে (Inland fishing) বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকারী দেশমাছ চাষের ক্ষেত্রে এদেশের অবস্থান পঞ্চমবাংলাদেশ, বছরে ,০০০ কোটি টাকার মাছ রপ্তানি করেএদেশের জাতীয় আয়ের ৩.৭০ ভাগ এবং রপ্তানি আয়ের ৪.০৪ ভাগ আসে মৎস্য খাত থেকে  কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে এই মৎস্য খাতের উপর পড়ছে বড় প্রভাব বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিক আচরণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেশের মৎস্যসম্পদের জন্য প্রতিকুল অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়তমৌসুমী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং অসময়ে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় মাছের প্রজননে নানাবিধ সমস্যা হচ্ছে, যেমন: প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় এবং তাপমাত্রা বেশি থাকায় মাছ কৃত্রিম প্রজননে সাড়া না দেয়ায় প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে, এজন্য ডিম শরীরে শোষিত হয়ে যাচ্ছেবিশেষজ্ঞরা জানান, তাপমাত্রা ২৯-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গেলে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায় ফলে পানিতে অক্সিজেন কমে যায়, আর তাতে প্রজননক্ষম মাছ অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েএমতাবস্থায় ডিমের আবরণ পাতলা হয়ে যায়এতে সমগ্র পোনা উৎপাদন ব্যাহত হয়
বাংলাদেশে এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টিতে পুকুর-ডোবাতে পানি জমেএসময় মৎস্যজীবিরা পোনা মজুদ করেন জমে থাকা পানিতে মাছের পোনা মজুদের দুই-তিন মাস পরে মাছ বাজারে আসার আকৃতি হওয়ার আগেই তীব্র তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে পানিফলে ছোট ছোট মাছ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় মৎসজীবিরমৎস্যজীবিদের অভিমত, অসময়ে কুয়াশা, আকাশ মেঘলা থাকাও মাছ চাষকে ব্যাহত করছেঅনেক ক্ষেত্রে স্বাদু পানির মাছ চাষে লোনা পানি ঢুকে পড়ে বাধাগ্রস্থ করছে মাছ চাষ; যেমন: মৃগেল মাছ লোনা পানি সহ্য করতে পারে না, রুই-কাতলা আশানুরূপ আকৃতি পায় না
বাংলাদেশে, রুইজাতীয় মাছের চারটি ভান্ডার রেয়েছে, যার মধ্যে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ভান্ডার ভারতের বিভিন্ন স্থানে ডিম ছাড়েএকমাত্র নদী হালদা, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে রুইজাতীয় মাছ ডিম ছাড়েপৃথিবীতে হালদাই একমাত্র নদী, যেখান থেকে রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করা হয় সাধারণত বৈশাখ মাসের প্রচন্ড তাপের পর একাধারে ৮-১০ ঘণ্টা বজ্রসহ ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার পর নদীর দুই পাশ ছাপিয়ে পানি পার্শ্ববর্তি নিচু প্লাবনভূমিতে যায়, প্রচন্ড বিদ্যুৎ চমকায়, নদীর বাঁকগুলোতে স্রোতসহ পানি ঘুর্ণায়মান থাকে, তাপমাত্রা ২৬-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে; তখনই রুইজাতীয় মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়েসাধারণত অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় সবকিছুর শুভ সংযোগ ঘটে, আবহাওয়ার অনুঘটকগুলো মিলে যায় একে অপরের সাথে আর তার প্রভাবে মাছ ডিম ছাড়েপরবর্তিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে ধীরে ধীরে প্রজননক্ষম মাছের ডিমের পরিপক্কতা এগিয়ে আসেকিন্তু হালদার ডিম উৎপাদনের চিত্র আর আগের মতো নেইবৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার সময় দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছেএতে করে মাছের জৈবিক অবস্থার সঙ্গে বৃষ্টিঘন সময়ের অমিল দেখা দিচ্ছেঅতীতে হালদায় ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ কেজি পর্যন্ত রুইজাতীয় মাছের ডিম পাওয়া যেতো, ৭০-এর দশকে ডিম উৎপাদন হাজার কেজি ছিলো, ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এসে তা মাত্র ২০ কেজিতে নেমে আসেযদিও জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তা আবার বেড়ে ১৭০ কেজি যায়ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে আবহাওয়ার এসব অস্বাভাবিক মেজাজ-মর্জির দরুন আরো কমে যাবে রুইজাতীয় মাছের উৎপাদন
চাঁদপুরের মতলব উত্তর মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ভরা বর্ষায়ও (আগস্ট) দেখা যায়নি ইলিশ মাছএসময় মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছ ডিম পাড়তে আসেকিন্তু ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টি, বজ্রপাত না থাকায় ইলিশ মাছ স্বাভাবিক নিয়মে সাগর ছেড়ে আসছে নাএতে ইলিশের উৎপাদনে যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা খুবই স্বাভাবিক
সিলেটের হাওরাঞ্চল
বাংলাদেশে প্রাপ্ত ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছই পাওয়া যায় হাওরাঞ্চলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি হাওর আছে সিলেট অঞ্চলেসিলেটের মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এলাকায় অধিকাংশ বিল ভরাট হয়ে গেছেদুটি জরিপ থেকে জানা যায় (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৯): ২৮১টি বিলের মধ্যে সম্পূর্ণ ও আংশিক ভরাট হয়ে গেছে ২৩৩টি বিলজলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে হাওরাঞ্চলের বিলগুলোতে পানির পরিমাণফলে যে বিলগুলো এখনও টিকে আছে, সেগুলোতে পানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ায় হুমকির মুখে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রাপ্তিযোগ্যতাএছাড়া সময়মতো বৃষ্টি হয় না, বা যখন হয়, তখন একসাথে অতিবৃষ্টি হওয়ার ফলে হাওর পানিতে ভরে গেলেও তা স্থায়ী হয় না, ফলে মাছ আসে নাএতে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছেঅভিজ্ঞদের বক্তব্য থেকে এর বিস্তারিত কারণ যা জানা যায় তা হলো, সময়মতো পানি না হলে মাছ ডিম ছাড়তে পারে নাবৃষ্টি হলে পানির তাপ কমে, এসময় মাছ ডিম ছাড়েবদ্ধ পানিতে উত্তাপ বেশি থাকে, তাই সময়মতো বৃষ্টির খুব বেশি দরকার

সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত "আলির হাওর"

 
কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জ উপজেলার তাড়াইলে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে (মাছের প্রজনন মৌসুম) পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্থ হয়, ফলে নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওরে পানি ছিলো না এবং মৎসজীবিরা মাছের ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত মাছ পাননিএলাকাবাসীর থেকে জানা যায় উপজেলার নরসুন্দা, সুতি, বেতাই, ফুলেশ্বরী, বর্মি নদী এবং মান্দারা, ফুলিয়া, বামিহা, গজারিয়া, দিগবাইতসহ বিভিন্ন হাওড় ও খাল-বিলে রুই, কাতলা, মাগুর, কই, পুঁটি, টাকি, পাবদা, গজার সহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে ঐ বছর
দুটি জরিপ থেকে জানা গেছে (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৯): হাকালুকি হাওরের ১০৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৩২ প্রজাতিই এখন হুমকির মুখেস্থানীয়দের থেকে জানা যায় হাওড়ে আগে যেখানে পাবদা, চিতল, কালবাউশ সহজেই মিলতো, ছোটখাটো একটা গর্তে শিং, মাগুর পাওয়া যেতো, এখন সেখানে চিংড়ি পাওয়াও মুশকিল
সিরাজগঞ্জ-পাবনা-নাটোরের চলনবিল
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া, পাবনার চাটমহর ও ভাঙ্গুরা এবং নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামসহ নয়টি উপজেলার প্রায় ১২০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেশের বৃহত্তর বিল চলনবিলে ভরা মৌসুমেও মাছের আকাল দেখা দিয়েছে (জানুয়ারি, ২০১০) দেশের এই বিশাল চলনবিল মাছের জন্য বিখ্যাতপ্রতি বছর এই বিল থেকে টনকে টন মাছ ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়এছাড়া প্রতি মৌসুমে প্রায় ১০০ কোটি টাকার শুঁটকি মাছ দেশ বিদেশে রফতানি হয়প্রতি বছর সব মিলে দেড় থেকে ২শ' কোটি টাকার মাছ আহরণ করা হলেও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে চলনবিলের দৃশ্য ভিন্নরকমউৎপাদন কম হওয়ায় যে পরিমাণ মাছ ধরা পড়ছে তাতে সংসার চলছে না মৎসজীবীদেরচাহিদানুগ সরবরাহ কম হওয়ায় মাছের দাম চড়াএদিকে উৎপাদন কম হওয়ায় দেশের বৃহৎ এই চলনবিলে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মৎস্য আহরণ কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা ২০১০ খ্রিস্টাব্দে বন্যা না হওয়ায় চলনবিলের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কম হয়বিলের বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি কম হওয়ার কারণে সূর্যের তাপে পানি গরম হয়ে দেশীয় প্রজাতিসহ সব ধরনের পোনা মাছ বিনষ্ট হয়এতে চলনবিল অধ্যুষিত এলাকায় প্রায় ১০,০০০ জেলে বেকার হয়ে পড়েছেবাজারে মাছের সরবরাহ কম হওয়ায় বরফের ব্যবসায়ে লোকসান যাচ্ছেঅন্যান্য বছরের তুলনায় ২০১০ খ্রিস্টাব্দে চলনবিলে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মাছের উৎপাদন কম হয়েছে এবং এই পেশার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫০,০০০ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে

নাটোরের চলনবিল

সাতক্ষীরা-খুলনার সুন্দরবন
সুন্দরবনের সামগ্রিক মাছের ওপর পূর্বাপর কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি ফলে মাছের বর্তমান অবস্থা, বিলুপ্ত মাছ, বিলুপ্তপ্রায় মাছের ওপর উপাত্তনির্ভর তথ্য পাওয়া যায় নাশুধু, মানুষ যেসব মাছ খায় এবং যেসব মাছ রপ্তানি উপযোগী, সেসব মাছ চিহ্নিত করা হয়েছেধারণা করা হয়, সুন্দরবনে শিরদাঁড়াওয়ালা মাছ রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতিরসাইডেনস্টিকার ও হাই-এর (পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭৮) মতে, এর মধ্যে বাণিজ্যিক মাছ ১২০ প্রজাতির; অবশ্য বার্নাকসেকের মতে, (২০০০) বাণিজ্যিক মাছ ৮৪ প্রজাতির, কাঁকড়া-চিংড়ি ১২ প্রজাতির ও ৯ প্রজাতির শামুক রয়েছে
সুন্দরবনে মৎস্যসম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়সব মাছ মিলিয়ে হয় সাদা মাছ, বাকিরা বাগদা, গলদা, কাঁকড়া
আশির দশকে চিংড়ির পোনা ধরা শুরু হওয়ার পর মাছের প্রাচুর্য হঠাৎ কমে যায়একসময় স্থানীয় জনসাধারণের প্রাণিজ প্রোটিন ৮০ শতাংশ মেটাতো মাছ এখন মাছ খাওয়ার সৌভাগ্য এলাকার খুব কম লোকের ভাগ্যে জোটেসুন্দরবনে কালা হাঙর, ইলশা কামট, ঠুঁটি কামট, কানুয়া কামট পাওয়া যায়আগে এদের খালিশপুর এলাকা পর্যন্ত পাওয়া যেতো, এখন (২০১০) অনেক দক্ষিণে সরে গেছেপশ্চিম সুন্দরবনে এদের উৎপাত বেশিএরা সংখ্যায় অনেক কমে গেছে, বিশেষ করে কালা হাঙর প্রায় দেখাই যায় না৯ প্রজাতির শাঁকজ বা শাপলাপাতা মাছের অধিকাংশই এখন (২০১০) সুন্দরবনের খাঁড়ি এলাকায় দেখা যায় না
কুঁচে কা কামিলা-জাতীয় মাছের পাঁচটি প্রজাতির সাগর কুইচ্চা ও ধানি কুইচ্চার অবস্থা খুবই খারাপআগের দিনে বাম মাছের মতো দেখতে এই মাছগুলো স্থানীয় লোকজন খেত নাএখনো খায় নাতবে হাজার হাজার কাঁকড়া মারা জেলে কুইচ্চা মাছের টুকরো কাঁকড়া ধরার টোপ হিসেবে ব্যবহার করেশীতকালে সাগরপারের জঙ্গলি খালে পূর্ণ জোয়ারের প্রায় স্বচ্ছ জলে আর্চার ফিশ বা তীরন্দাজ মাছ দেখা যেতোতিতপুঁটি মাছ আকারের এই মাছগুলো জলের এক-দেড় ফুট ওপরে গাছের পাতা বা ডালে পিঁপড়ে কিংবা মধ্যম আকৃতির বিভিন্ন পতঙ্গ দেখে পিচকারীর মতো তীব্র জল ছিটিয়ে পোকাটিকে ভিজিয়ে জলে ফেলে খেয়ে নেয়এই মাছ পূর্ণবয়সকালে ফুটখানেক লম্বা হয়এই মাছগুলো আজকাল আর দেখি না একসময় জাভা মাছের খুব নাম শোনা যেতো, এরা ৫৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়এখন (২০১০) দেখা পাওয়া ভারপায়রাতলী বা চিত্রার মতো অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ আজকাল জেলেদের জালে খুব কম পড়ছে
সুন্দরবনের সবচেয়ে পরিচিত মাছ পারশে মাছ১৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা এ মাছটি জঙ্গলের সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতোএখনো পাওয়া যায় খুব কমপারশেরই জাতভাই বাটা ভাঙানভাঙান, গুল বাটা, খরুল ভাঙান আজকাল খুব কম ধরা পড়েখরশুলা বা খল্লা অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ; বনের নদী-খালে এদের তেমন আর দেখতে পাওয়া যায় না
সুন্দরবনের কাইক্কা বা কাইকশেল মাছ স্বাদু পানির কাইক্কার চেয়ে আকারে অনেক বড় হয়এখানকার এই ঠুঁটি কাইকশেল এখন (২০১০) খুব কম ধরা পড়েবিশাল আকৃতির মেদ মাছের দুটি প্রজাতি এখন বিলুপ্তপ্রায়
মারাত্মক মাছ কান মাগুর-এর পাশের কাঁটায় মারাত্মক বিষ রয়েছেবড় কান মাগুর এখনো (২০১০) কিছু পাওয়া গেলেও দাগি কান মাগুর এখন বিলুপ্তপ্রায় ট্যাংরা জাতের গুলশা ট্যাংরা, নোনা ট্যাংরা এখনো কিছু পাওয়া গেলেও বিশাল আকৃতির শিলং মাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছেকাজলী মাছও সহসা চোখে পড়ে না অপূর্ব সুন্দর ভোল মাছসুন্দরবনের সবচেয়ে বড় মাছ কই ভোল এখন ধরা পড়ে কালেভদ্রেআগে সুন্দরবনের খালে কুৎসিত দর্শন গনগইন্যা মাছ বড়শিতে ধরা পড়তো এখন (২০১০) তেমন একটা পাওয়াও যায় নারেখা মাছ একসময় বেশ দেখা যেতো, ইদানীং দেখা পাওয়া যায় না
গুটি দাতিনা এখনো (২০১০) পাওয়া গেলেও লাল দাতিনা একেবারেই বিরল হয়ে গেছেসুন্দরবনের নদী-খাঁড়িতে মাঝ ভাটায় অত্যন্ত সুস্বাদু লাক্ষা মাছ (স্থানী নাম তাড়িয়াল মাছ: Indian Salmon) দারুণ আলোড়ন তুলে ছোট, মাঝারি পারশে, দাতিনা মাছ তাড়িয়ে বেড়ায়এরা আকারে প্রায় চার ফুট লম্বা হয়এদের মতোই তপসে মাছের (স্থানীয় নাম রামশোষ) আকাল দেখা দিয়েছে (২০১০)জেলেরা অন্তত পাঁচ প্রজাতি চেউয়া মাছ ধরে বড় নদীতেএর মধ্যে লাল চেউয়া বিপন্ন হয়ে উঠেছেসুন্দরবন তথা পৃথিবীর সব ক্রান্তীয় ম্যানগ্রোভ বনের প্রতীক মাছ হলো মেনো মাছ (Mud Skipper), কোথাও ডাহুক মাছ নামেও পরিচিতবনে এদের পাঁচটি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়প্রজাতিভেদে এরা ৯ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়
বনের বলেশ্বর, কুঙ্গা নদীতে যথেষ্ট ইলিশ ধরা পড়েদুই প্রজাতির ইলিশের মধ্যে চন্দনা ইলিশ কম পাওয়া যায় (২০১০)৪ প্রজাতির ফ্যাসা মাছের মধ্যে রাম ফ্যাসা কম পাওয়া যায় (২০১০)বৈরাগী মাছের সংখ্যাও কমেছেসুন্দরবনের ভেতর পোড়ামহল, আন্ধারমানিক, জোংরা, শুবদি-গুবদি এলাকার মাঝারি আকারের বিলগুলোতে বর্ষায় পানি আটকে যায়, কোথাও জোয়ারের পানি ঢোকেএই বিলগুলোর পানি মিঠা, এখানে মিঠাপানির মাছ পাওয়া যায়বেশির ভাগ জিওল মাছ কই, শিং, মাগুর, দুই প্রজাতির টাকি, শোল ছাড়াও ছোট ট্যাংরা, পুঁটি, খলসে, চ্যালা, দাঁড়কিনা, কুঁচো চিংড় সহ নানা মাছ পাওয়া যায়বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এসব বিলে লোনা পানি ঢুকছেএই বিলগুলোর মাছ তাই শেষ হওয়ার দিন গুনছে

জীবজন্তুর অবলুপ্তি বা সংখ্যাগত বিপুল তারতম্য

সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে হারিয়ে যাবে, বা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে দেশের বিপুল পরিমাণ জীবজন্তুসমুদ্রের লোনা জলের উচ্চতা বাড়লে খুলনার সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণোপযোগী বনভূমি কমে যাবেএতে বাঘের শিকার কমে যাবে, ফলে স্বভাবতই বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবেগাঙে বিচরণকারী শুশুক কমে যাবে মায়া হরিণ চিরতরে হারিয়ে যাবে চিত্রা হরিণও কমে যাবে শঙ্খচূড় সাপ কমে যাবেমাস্কড কিনফুট একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবেপলাশ ফিশ ঈগলও নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞের ধারণা ইতোমধ্যেই (২০১০) নদীতে বিচরণকারী শুশুক কমে এসেছে
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে বানর এবং ভোঁদড়ের সংখ্যায় তেমন হেরফের হবে নামাটির তলাবাসী, চরবাসী প্রাণসম্পদ বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞের ধারণাতবে কীটপতঙ্গ, যেমন: মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবেকীটপতঙ্গের সংখ্যাবৃদ্ধি মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা

রয়েল বেঙ্গল টাইগার

উদ্ভিদ প্রজাতি ধ্বংস

বাংলাদেশের সিলেটের হাওরাঞ্চলে সাধারণত দুধরণের গাছ জন্মে: শেকড়ধারী (rooted) আর ভাসমানহাওরে পানি কম হলে শেকড়ধারী উদ্ভিদের পরিমাণ বেড়ে যায়এভাবে একপ্রকারের গাছ বেশি হলে অন্যপ্রকারের গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়আবার একপ্রকারের গাছ থেকে পশু-পাখি-মাছ পর্যাপ্ত সকল খাদ্য উপাদান পায়ও নাহাওরাঞ্চলে আগে যেখানে গভীর জঙ্গল ছিলো, এখন (২০০৯) সেখানে ধুধু করছে উদম হাওরস্থানীয়দের অভিমত থেকে জানা যায় বদলে গেছে চেনা হাওরাঞ্চলের রূপএখন আর সময়মতো বৃষ্টি হয় না, যখন হয়, তখন একসাথে অতিবৃষ্টি হয়এতে হাওর পানিতে ভরে গেলেও তা স্থায়ী হয় না, ফলে জলজ উদ্ভিদ আর প্রাণীবৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখিনএতে হাকালুকির চিরচেনা হিজল, করচ , জারুল, বরুণসহ বৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত জলজ উদ্ভিদের অবস্থা বিপন্নএছাড়া পানির অভাবে পানিবাহিত প্রজননের অভাবে অনেক গাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে; যেমন: কিছু গাছের ফল গাছে থাকতেই সেগুলোতে শিকড় গজাতে শুরু করে, ফলে সেগুলো বোঁটা ছিঁড়ে নিচে পড়তেই চারা গজানো শুরু করেনিচে পানি থাকলে ফলগুলো ভাসিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছ জন্মাতে পারেকিন্তু প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে এক জায়গায় সব ফল পড়ে তেমন কোনো উপকারই হয় না
খুলনার সুন্দরবনে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়তে থাকলে, ধীরে ধীরে ভূ-ভাগের পরিমাণ কমে যাবে এবং নতুন নতুন খাঁড়ির সৃষ্টি হবেমাটি ধ্বসে বা ক্ষয়ে গিয়ে জমি বা বনের এলাকা কমে পানির এলাকা বেড়ে যাবেনতুন চরায় গর্জন, গরান, গেওয়া, কিছু পরিমাণ পশুর, ধুন্দল ছাড়া অন্য গাছ টিকতে পারবে নাএছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই (২০০৯) সুন্দরবনের]] সুন্দরী গাছে ব্যাপক মাত্রায় আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে অন্যান্য গাছও আগামরা ও পাতা কঙ্কালকরণ পোকার আক্রমণের শিকার হচ্ছে আক্রান্ত হচ্ছে বাইনের বাগানওফলে হ্রাস পাবে সুন্দরবনের মূল অহঙ্কার সুন্দরী গাছের সংখ্যাউল্লেখ্য, পূর্ব সুন্দরবনের ৬৬% জুড়ে রয়েছে সুন্দরী গাছআরো কমবে আমুর গাছের পরিমাণওঝানা, গুড়াল, কাঁকড়া গাছের পরিমাণ বাড়লে, জ্বালানী কাঠ বাড়লেও আসবাব-উপযোগী কাঠ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য গাছের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে গোলপাতার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যাবে

পক্ষী প্রজাতির বিলুপ্তি

বাংলাদেশে, পাখি শ‌ুমারির হিসেবমতে, ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে মোট ১৬০ প্রজাতির পাখি দেখা গেলেও ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে এসে তার সংখ্যা মাত্র ৬৮৷ সংখ্যা হ্রাসের পাশাপাশি পাখিদের প্রজাতিগুলোও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছেএর মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে জলচর পাখিরা

কৃষিভিত্তিক উৎপাদন হ্রাস বা ধ্বংস

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য যেখানে ছিলো যথাযোগ্য তাপমাত্রা, ছিলো ছয়টি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ঋতু, সেখানে দিনে দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু হারিয়ে যেতে বসেছে এবং তার সাথে সাথে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসছেফলে অনিয়মিত, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত; সেচের পানির অপর্যাপ্ততা; উপকূলীয় অঞ্চলে বর্ষা মৌসুম ছাড়াও বিভিন্ন সময় উপকূলীয় বন্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিতে লবণাক্ত পানিতে জমি ডুবে যাওয়া, এবং শুষ্ক মৌসুমে মাটির নিচের লবণাক্ত পানি উপরের দিকে বা পাশের দিকে প্রবাহিত হওয়ার মতো নানাবিধ সমস্যায় বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে
এদেশের মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার কারণে এদেশের প্রধান অর্থকরি ফসল হলো ধান কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে দিনে দিনে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ধানচাষধান চাষের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ১৮°-৩৫° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকা প্রয়োজনফসলের ফুল ধরার সময় তাপমাত্রা ১৮° সেলসিয়াসের থেকে কমে গেলে ধানের বীজ হলদেটে ও দুর্বল হয়ে পড়ে, আবার ৩৫° সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি হলে বীজ কালচে হয়ে যেতে পারে তাপমাত্রা ছাড়াও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে, কিংবা প্রবল শিলাবৃষ্টিতে, কিংবা অসময়ে বন্যায় ধানচাষের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়
বাংলাদেশের সোনালী আঁশ, পাটের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাষীরা পাট চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছেবাংলাদেশের কৃষি তথ্য সার্ভিসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়: এদেশে ১৯৭২-১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাটচাষের জমি ছিলো গড়ে ১,৭৭৯ একর (গড় উৎপাদন ৯৫৩ টন)সেখানে ২০০১-'০৭ পর্যন্ত সময়কালে চাষের জমি মাত্র ৮৬৪ একর (গড় উৎপাদন ৯১২ টন)পাট চাষের এই ক্রমাবনতির জন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করে থাকেন তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনগত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে দেশী জাতের পাট চাষ করা হয় না, হয় তোষা জাতের পাটের চাষআগে নিচু এলাকায় পাটের চাষ হলেও এখন উঁচু এলাকায় হচ্ছেআগে দেশের পূর্বাঞ্চলে ভালো পাট জন্মালেও এখন পাট চাষ উত্তরাঞ্চলে সরে এসেছে
রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের "বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টা" সংগঠনের মাধ্যমে জানা যায়, এলাকার চারঘাট, বাঘা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে রেশমের আষাঢ়ী মৌসুমের পুরোটাই, কোনো গুটি না হওয়ায় মার খেয়েছে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার নলতৈড়, কালীনগর, চকদেবীরাম, দৌডাঙ্গি, ছোটমুল্লুক, চকগোবিন্দ, থানতলা ও রামনগর গ্রামে বিগত চার বছর (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৯) ধরে অপ্রতুল বৃষ্টিপাতের দরুন, এই এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল বর্ষাকালীন মরিচের চাষ ঠিকমতো হচ্ছে না
আবার অসময়ে বৃষ্টিপাত কিংবা বন্যার দরুন ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্ন রকম ফসলযেমন: বর্ষার মাঝামাঝি বন্যা এদেশে চিরায়ত কাল ধরে স্বাভাবিক বিধায় এই সময়টুকু মাথায় রেখেই দেশের কৃষকরা চাষাবাদ করেনকিন্তু দেশের উত্তর-পূর্বাংশে, নিকটবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের ঢল থেকে সৃষ্টি হওয়া অনিয়মিত বন্যা ব্যাপক ফসলের ক্ষতিসাধন করে জুন-জুলাই মাসে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে গেলে হাওর অঞ্চলে শস্যের তেমন ক্ষতিসাধন না করলেও পাট, আখ ও অন্যান্য নিচু জমির ফসল নষ্ট করেএরকম বৃষ্টি আমন ধানের বীজতলাও নষ্ট করে দেয় এছাড়া বন্যা কিংবা নদীভাঙনের ফলে হওয়া ভূমিক্ষয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় বাদামের চাষ
এছাড়া দেশে তাপ ও শৈত্যপ্রবাহের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গ্রীষ্মকালে বর্ধিত তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে রবিশস্যের আবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে (২০০৯)শীতকালের স্থায়িত্ব কমে গেছে বলে রবিশস্যের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে নাআবার শৈত্যপ্রবাহের ফলে সরিষা, মসুর, ছোলা সহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেশৈতপ্রবাহের কুয়াশার কারণে গমসহ বিভিন্ন ফসলের পরাগায়ণ ও বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে
এসব ছাড়াও খরার কারণে ধান, পাটসহ অন্যান্য ফসল ও সবজির চাষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে মার্চ-এপ্রিলের খরা, চাষের জমি তৈরিতে অসুবিধার সৃষ্টি করে, ফলে বোনা আমন, আউশ ও পাট চাষ যথাসময়ে করা যায় না মে-জুন মাসের খরা, মাঠের উঠতি বোনা আমন, আউশ ও পাটের চাষকে বাধাগ্রস্ত করে আগস্ট মাসের খরা, রোপা আমন চাষকে বাধাগ্রস্থ করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের খরা, বোনা ও রোপা আমন ধানের উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং ডাল আলুর চাষকে বিলম্বিত করে কাঁঠাল, লিচু, কলা প্রভৃতি ফলের গাছ অতিরিক্ত খরায় মারা যায়এছাড়া শীতকালীন সবজি ও আখ চাষও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়

খাদ্যসংকট

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ উদ্ভূত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি নদ-নদীর পানিহ্রাস, জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ধীরে ধীরে দেখা দিবে খাদ্য সংকটইতোমধ্যেই (২০০৯) খুলনা বিভাগের কয়রা, সাতক্ষীরায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুহারা মানুষেরা সর্বোচ্চ দুই বেলা খেতে পারে ভবিষ্যতে এই খাদ্যসংকট হয়ে উঠবে আরো চরম

জীবনোপকরণ হ্রাস

সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে খুলনার সুন্দবনের বিপুল প্রয়োজনীয় গাছ-গাছালি হ্রাস পাবে, কিংবা হারিয়ে যাবে, কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হবে; এমনকি সুন্দরবনের মূল পরিচায়ক সুন্দরী গাছের ব্যাপক হ্রাসে মানুষ নৌকা বানানোর কাঠ এবং ঘরের খুঁটির জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের অভাবে পড়বে গোলপাতার অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় গোলপাতার ছাউনিনির্ভর সুন্দরবন এলাকাবাসী ব্যাপক সমস্যার সম্মুখিন হবে

জীবিকার উৎস ধ্বংস

লবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশনির্ভর উপজীবিরা তাদের জীবিকা হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়বেএতে দেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবেযেমন মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্বাদু পানির মৎসজীবি, সমুদ্রগামী জেলে, উপকূলীয় জেলে ও তাদের পরিবারগুলো জীবিকার উৎস হারাবে এরকম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারেরই ,০০,০০০ জেলে ইতোমধ্যেই (২০১০) চাঁদপুরের মতলব উত্তর মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ভরা বর্ষায়ও মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছের দেখা না পাওয়ায় মেঘনা উপকূলীয় ষাটনল জেলেপাড়া, ষটাকী, মোহনপুর, আমিরাবাদ ও কানুদী অঞ্চলের জেলেরা হতাশায় ভুগছেন, মৎস্যহীন হয়ে পড়েছে মৎস্য আড়তগুলো এছাড়া ঘন ঘন বন্যা বা দীর্ঘমেয়াদি বন্যা মানুষের কাজের সুযোগ কমিয়ে দেয়শহরাঞ্চলে দুর্বল পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থার কারণে জলাবদ্ধতায় কম আয়ের মানুষের আয়ের সুযোগ সীমাবদ্ধ করে তোলে

২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ থেকে ২১ জুলাই টানা ৯ দিন উত্তাল সমুদ্রের কারণে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যায় আবহাওয়া অধিদপ্তরএসময় কোনো জেলের পক্ষেই সমুদ্রে মাছ ধরতে নামা সম্ভব হয়নিকক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির দেয়া তথ্যমতে, ঐ বছর আগস্ট মাসে জেলেরা মাত্র ৫ দিন, সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ৬ দিন এবং অক্টোবর মাসে মাত্র ১২ দিন সাগরে মাছ ধরতে নামতে পেরেছেন ২০১০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসেও অনুরূপভাবে টানা ৮দিন উত্তর বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ থাকায় ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যায় আবহাওয়া অধিদপ্তর অনেকেই বদলাতে শুরু করেছেন নিজেদের পেশা (২০০৯), কেউবা ধরছেন রিকশা চালানো, কেউবা শুরু করছেন দিনমজুরগিরি উপকূলের মৎস্যজীবিদের উপর তাই ইতোমধ্যেই নেমে এসেছে ভীষণ দুর্ভোগ চকরিয়া, মহেশখালী, লক্ষ্মীপুর, চরফ্যাশন, কলাপাড়া ও পাথরঘাটার ৩.৫ লাখ মৎস্যজীবির মধ্যে প্রায় ২.৫ লাখ মৎস্যজীবি বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত
এছাড়াও জলোচ্ছাসে ধুয়ে নিয়ে যায় উপকূলবর্তী মানুষের উপার্জনের একমাত্র সহায় গবাদি পশু, পাখি, ও ফসলের জমিঅনেক প্রান্তিক চাষী ঋণ করে জন্মানো ফসল হারিয়ে হয়ে পড়েন নিঃসম্বলএছাড়া শিল্পভিত্তিক উপার্জনকারীরা নিজেদের শিল্পকারখানা ধ্বংসের কারণে জীবিকার উৎস হারান

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষশ্বাসকষ্ট, হীটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠান্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেবিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য-প্রভাব নিয়ে করা তাদের গবেষণা রিপোর্টে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে, সে সম্বন্ধে উল্লেখ করেছে: সংক্রমণ ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ধরণে পরিবর্তন আসবে; তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে; জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি জখমের সংখ্যাও বাড়বে তা ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে শারীরিকভাবে আহত হোন শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধগণএছাড়া বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে শিশুরা মানসিকভাবেও হয়ে পড়ে পর্যুদস্ত বিপুল মানুষ নিজস্ব আবাস ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবনে পদার্পণ করায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে গর্ভবতি মায়েদের জীবনেতারা পাননা ন্যূনতম স্বাস্থ্য-সুবিধা, ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালনের কারণে অনায়াসেই সন্তানের শরীরে জায়গা করে নেয় নানা রোগব্যাধী এছাড়া উদ্বাস্তু জীবনে বয়ঃসন্ধিকালে, কিশোর-কিশোরীরা পায়না উপযুক্ত ন্যূনতম পরিবেশ

অপুষ্টি

দেশের মৎস্যসম্পদসহ প্রাকৃতিক সম্পদ দিনে দিনে যে হারে হ্রাস পাচ্ছে, তাতে স্বল্প আয়ের মানুষ অপুষ্টির শিকার হবেছোট মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় দেখা দিবে আমিষ ঘাটতি

রোগব্যাধি

খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসূত্রে জানা গেছে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা এবং জলাবদ্ধতাসহ একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে কয়রা, সাতক্ষীরা প্রভৃতি এলাকার বাস্তুহারা মানুষের মধ্যে হতাশা (Mass Psychosis Illness) নামক মানসিক ব্যাধি দেখা দিচ্ছেস্থায়ী বসতিতে ফিরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে না পারলে এই রোগের তীব্রতা বাড়তে পারে বলে চিকিৎসকগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন (২০০৯) বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায়, বিশেষ করে খুলনা এলাকায় লোনা পানির দাপটে নদীর পানিও লোনা হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে সে পানি পান করায় ঐ এলাকার মানুষের মাঝে দেখা দিচ্ছে নানারকম পেটের পীড়া ও চর্মরোগ
বাংলাদেশে, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (ICDDR,B) গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ডায়রিয়ার জীবাণুর বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে এবং ডায়রিয়ায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেসংস্থাটির, ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের গবেষণায় বেরিয়ে আসে: ডায়রিয়া বা কলেরার জীবাণু নীলাভ-সবুজ শ্যাওলা আঁকড়ে পানিতে ভাসে, এবং তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে শ্যাওলা বাড়ার সম্পর্ক আছেবিশেষ করে এপ্রিল-মে -এই দুই মাসে এবং সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর এই চার মাসে ডায়রিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে শ্যাওলা বাড়ার সাথে সাথে হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়এছাড়া, আকাশে মেঘ কম থাকলে প্রখর সূর্যের আলো সালোকসংশ্লেষণে সহায়ক বলে শ্যাওলা আরো বেড়ে যায় এছাড়া বিশুদ্ধ পানির অভাবে ট্র্যাকোমা-জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে; ট্র্যাকোমা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে
অ্যাকশন এইড-এর (Action Aid) পক্ষ থেকে জানা যায়, দাকোপসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র থেকে ভূভাগের অনেক ভিতর পর্যন্ত লোনাপানি ঢুকে পড়েছে, ফলে লোকজনকে, পানি ও খাবারের সাথে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে লবণ গ্রহণ করতে হচ্ছেএতে ঐসকল এলাকার লোকজন উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure) রোগে ভোগার সম্ভাবনা বাড়ছেগবেষণায় দেখা গেছে লবণাক্ততায় আক্রান্ত এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের প্রি-একলেম্পশিয়া (Pre-eclampsia) ও উচ্চরক্তচাপের হার ৬.৮%, ফেব্রুয়ারি মাসে লবণাক্ততা বেড়ে যায় বলে তখন এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯.৫ শতাংশে
এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতা ও বন্যার কারণে মশার প্রজনন বেড়ে যায়, এবং তাদের বংশবৃদ্ধির সময় দীর্ঘায়িত হয়ফলে মশাবাহিত নানা রোগ, বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়বে

জলবায়ু উদ্বাস্তু বৃদ্ধি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে৷ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সংবাদ মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১-১.৫ কোটি মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে  ইতোমধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বিপুল সংখ্যক (প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ) মানুষ ছেড়েছে খুলনার কয়রা এলাকা; পাড়ি জমিয়েছে ঢাকা, রাঙ্গামাটি কিংবা খুলনা সদরে  ভোলাতে রাজাপুর ইউনিয়নের তথ্যমতে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ৬৫০টি পরিবার ঘর-জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৪২,০০০ মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে হঠাৎ বন্যায় লোকালয়ে লোনাপানি ঢুকে যাবার কারণে
খুলনার সুন্দরবন এলাকার পশ্চিমাঞ্চলের আংটীহারা গ্রামে, শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে দেখতে পাওয়া একগ্রাম মুন্ডা থাকলেও, ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের নদীভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে গেছে তারাতাদের পুরো গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে
এসকল উদ্বাস্তুর কারণে বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে রাজধানী শহর ঢাকায় ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ছিলো ১,৭৭,০০০, সেখানে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১,৬০,০০,০০০ বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবমতে, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২ কোটি
এছাড়াও মুহুর্মুহু নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তি পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়ফলে অসময়ে বাবা-মাকে হারিয়ে এতীম হয়ে যায় অনেক শিশুআর্থিক অনটন ও জীবন-জীবিকার উৎস হারিয়ে পড়া সেসব পরিবারের শিশুরা ভোগে নানা রোগে-শোকেবন্ধ হয়ে যায় তাদের লেখাপড়া, জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যেতে বসে সেসব শিশুরা
এছাড়াও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গবেষণা প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গড়ে বছরে ,২৪১ জন মানুষ মারা যাচ্ছে

বাংলাদেশের জলবায়ু উদ্বাস্তু

সামাজিক অবক্ষয়

ভূমণ্ডলীয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রভাবিত হবে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থাউপকূলীয় এলাকায় বর্ধিত হারের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষএসকল আশ্রয়হীন উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিচ্ছে নিকটবর্তি বড় শহরগুলোতে, কিংবা রাজধানী শহরেফলে বাড়ছে সেসব শহরের জনসংখ্যাবাড়তি জনসংখ্যার চাপ সামলাতে সেসব শহরগুলো হিমশিম খাচ্ছে এছাড়া এসকল উদ্বাস্তুরা এসে ঢাকা শহরে বস্তির বাসিন্দা হচ্ছেন ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের এক জরিপে দেখা যায় ঢাকায় ৩০,০০,০০০ মানুষ, অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন মানুষ বস্তিতে বাস করে এভাবেই বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা, ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য হয়ে উঠছে আরো স্পষ্ট অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য আয়ের অতিরিক্ত উৎস তৈরি না হওয়াতে উদ্বাস্তু মানুষেরা বেছে নেয় নানা অপকর্মের পথসমাজে দেখা দিতে শুরু করেছে বিশৃঙ্খলা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে দিনের পর দিন (২০০৯-২০১০)
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নারীরাযেখানে, বিভিন্ন দুর্যোগমুহূর্তে প্রতি ১,০০০ জনে ১৫ জন পুরুষ মারা যান, সেখানে প্রতি ১,০০০ জনে ২০-২৪ বছর বয়সী নারী মারা যান ৭১ জন এর ফলে দিনে দিনে সমাজে নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে এবং বিবাহের প্রয়োজনে পুরুষগণ নারীর অভাবে পড়বেন বিবাহযোগ্য বয়সে বিবাহের অনিশ্চয়তায় বিপথে পা দিবেন অনেক যুবক, সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে আরো মারাত্মকভাবেএছাড়াও দুর্যোগের মুহূর্তেও আশ্রয়ে থাকাকালীন নানারকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হোন অনেক অক্ষম নারী

অর্থনৈতিক ক্ষতি

ব্যক্তিগত পর্যায়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগে মানুষদের সহায়সম্বল হারাতে হয়গৃহস্থ পরিবারের গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস, মুরগি, বৃক্ষাদি, শস্য, মৎস্য সম্পদ, শস্যবীজ, গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য, এমনকি মাছ ধরার জাল, ঝুড়ি, কিংবা জমি চাষের লাঙ্গল-জোয়াল হারিয়ে যায় বড়সড় ঝড় কিংবা জলোচ্ছাসেবড় ধরণের জলোচ্ছাসের পর গবাদি পশুর শুকনো খাদ্যের আকালে পড়ে অনেক পরিবারএছাড়া সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের পর লবণপানির প্রভাবে লবণাক্ত জমি হয়ে পড়ে অনুর্বরফলে কখনও সাময়িক, কখনও দীর্ঘ সময়ের জন্য এক বিরাট আর্থিক অনটন কিংবা দুর্যোগের মুখোমুখি হোন দুর্যোগ-আক্রান্ত মানুষেরা
জাতীয় পর্যায়ে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রয়োজনে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছেনানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে ও চলমান দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বিদ্যমান অবকাঠামোগত স্থাপনায় আনতে হয় নকশাগত ও আবকাঠামোগত পরিবর্তনযেমন: লোনা পানি ঠেকাতে দেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলোর নকশা পাল্টে মেরামত ও নতুন পোল্ডার তৈরি করা এবং নদীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি ও আচরণগত পরিবর্তনে সেচ প্রকল্পের সংস্কার সাধন তাছাড়া উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির সংস্কার কিংবা পুণর্নির্মাণে প্রতি বছর বাজেটে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হয়দাতা সংস্থাসমূহ এই ব্যয় বহন করতে অস্বীকৃত হলে বাংলাদেশ সরকারকে অভ্যন্তরীণ আয় থেকেই এসকল ব্যয় নির্বাহ করতে হয়ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে অর্থঘাটতি দেখা দেয়ফলে সরকারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হয়
অথচ যেভাবে চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ সরকারের মূল আয়ের উৎসগুলো বন্ধ হতে চলেছে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন কমে গেলে সরকার রাজস্ব এবং রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ হারিয়ে ফেলবেএমতাবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি আয়ের তুলনায় ব্যয়ের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়বে
বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিরাট অংশ মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা থেকে শুরু করে চিকিৎসা খাতও এর উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীলবাংলাদেশে প্রায় ১,৪৭,০০০ হেক্টর পুকুর, ,৪৮৮ হেক্টর বাওর এবং ১১,০০,০০,০০০ হেক্টর চিংড়ি ঘেরে মাছ চাষ হয়এছাড়া প্রায় ৪৪,৭০,০০০ হেক্টর মুক্ত জলাশয়ে (নদী, হাওর, বিল, খাল) ২৫০ প্রজাতির মাছের বসবাস, যার মধ্যে ২৪টি প্রজাতির প্রজননও এখানেই হয়ে থাকে এই বিপুল মৎস্যসম্পদ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখেএই বিপুল সম্পদে আঘাত লাগলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গবেষণা প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ২,১৮৯ মিলিয়ন ডলার, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে যা ১.৮১% নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেপ্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সারা বিশ্বে হওয়া ক্ষতির প্রায় ২০%-ই বাংলাদেশে হয়েছে

No comments: